কক্সবাজার প্রতিনিধি ::
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের ঝিলংজা বীজ উৎপাদন খামার গিলে খাচ্ছেন অফিসটির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-এমনই অভিযোগ ওঠেছে। পাকিস্তান আমলে প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণ চট্টগ্রামে কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের সবচেয়ে বড় সম্পদ হচ্ছে ঝিলংজা বীজ উৎপাদন খামার।
ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানটির সহায়-সম্পদ একে একে সবই শেষ হয়ে গেছে। সর্বশেষ প্রতিষ্ঠানটির অফিস কম্পাউন্ডের পাহাড়ি মাটি এবং বীজ উৎপাদন কেন্দ্রের ফসলি জমির টপ সয়েল পর্যন্ত রাতের আঁধারে বিক্রি করে ফেলা হচ্ছে।
সোমবার সকালে সরেজমিন ঝিলংজা বীজ উৎপাদন খামারে গিয়ে দেখা গেল, প্রধান গেটটিতে তালা লাগানো রয়েছে। কেন্দ্র বা খামারের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী অফিস খোলার দিনেও অনুপস্থিত। একটি সরকারি অফিসের সকল দরজা-জানালা বন্ধ। খামারটির নিজস্ব জমির পাকা ধান কেটে মাড়াইয়ের জন্য আনার দায়িত্বে থাকা মাস্টাররুলের কর্মচারী ভানু বড়ুয়া বললেন, ‘খামারের দায়িত্বে নিয়োজিত সিনিয়র সহকারী পরিচালক (খামার) সুমন চাকমা রবিবার থেকে অফিসে নেই। রবিবার রাতে তিনি ঢাকা যাওয়ার কথা বলে গা ঢাকা দিয়েছেন। তাঁর মোবাইল ফোনও বন্ধ রয়েছে। ’
এমন অবস্থায় সোমবার সকাল ১১-২০ মিনিটে ঝিলংজা বীজ খামার থেকে রাজধানী ঢাকায় বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের সহকারী ব্যবস্থাপক (এজিএম) খামার জসিমুদ্দিনকে মোবাইলে এসব বিষয় এ প্রতিবেদক অবহিত করেন।
একটি সরকারি সংস্থার দেউলিয়াপনা সংক্রান্ত বিষয় জানানোর পর প্রতিউত্তরে এজিএম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সাংবাদিক সাহেব এসব বিষয় নিয়ে সংবাদ প্রকাশ না করার জন্য আমি অনুরোধ করছি।
কেননা এসব প্রকাশ হলে কৃষি বিভাগের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে। ’ তিনি আরো বলেন, ‘কক্সবাজারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুমন চাকমাকে ইতোমধ্যে এসব কারণে বদলি করা হয়েছে। কাল-পরশু একজন নতুন কর্মকর্তা যোগ দেবেন। ’
অপরদিকে ঝিলংজা বীজ উৎপাদন খামারের সহায়-সম্পদ বেহাত হয়ে যাওয়ার বিষয় নিয়ে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসকের সঙ্গে সোমবার যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি ইতোমধ্যে খবর পেয়েছি। কক্সবাজার সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (তদন্ত) সরেজমনি তদন্তে গিয়ে সরকারি জমির টপ সয়েল বিক্রির বিষয়টিও হাতেনাতে উদঘাটন করেছেন। ’
মাস্টাররুলের কর্মচারী ভানু বড়ুয়াকে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে প্রবেশের অনুরোধ জানালে তিনি বলেন, ‘এখানে সাংবাদিক প্রবেশ একেবারেই নিষিদ্ধ। ’ এমন সময় মাষ্টাররুলে নিয়োজিত আরো কয়েকজন কর্মচারী এগিয়ে এসে খামারের ভিতরে প্রবেশ করতে সহায়তা করেন।
খামারের অফিসে গিয়ে দেখা গেছে, সকল দরজা-জানালা বন্ধ রয়েছে। সেখানে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেও খামারটির কোনো নিয়মিত কর্মচারীকে পাওয়া যায়নি। খামারের পশ্চিমে গিয়ে দেখা গেছে, বিরাট পাহাড়ি এলাকার মাটি কেটে গর্ত করে ফেলা হয়েছে।
উপস্থিত কামাল উদ্দিন নামের এক ব্যক্তি জানান, প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র সহকারী পরিচালক (খামার) সুমন চাকমা নিজেই প্রতিট্রাক ৩৫০ টাকা করে গোপন চুক্তিতে স্থানীয় মাটি ব্যবসায়ীদের নিকট বিক্রি করে দিয়েছেন। গত কিছুদিন ধরেই রাতের আঁধারে এসব মাটি কেটে পাচার করা হয়। ইতোমধ্যে কয়েক লাখ টাকার মাটি বিক্রি করা হয়েছে অফিস কম্পাউন্ড থেকে। অফিস কম্পাউন্ডের কয়েক লাখ টাকা মূল্যের প্রতিটি বড় আকারের সেগুন গাছও কেটে বিক্রি করা হয়েছে। এসব সেগুন কাঠের গোড়ালি এখনও অক্ষত রয়েছে।
জানা গেছে, খামারে সরকারি জমি রয়েছে ৮৩.৭৩ একর। এসবের মধ্যে ৫০ একর জমিতে ধানচাষ করা হয়। এ পরিমাণ জমিতে কমপক্ষে ২ থেকে আড়াই হাজার মণ ধান উৎপাদন হওয়ার কথা। কিন্তু সরকারি গুদামে ধান রাখা হয় না। সব ধানই রাতের আঁধারে বিক্রি করে দেওয়া হয়। গত কয়েকদিন আগেও রাতের আঁঁধারে ৫ লক্ষাধিক টাকা মূল্যের ধান বিক্রি করে দেওয়ার অভিযোগ ওঠেছে।
প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র সহকারী পরিচালক (খামার) সুমন চাকমার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠেছে, তিনি ব্যবসায়ীদের নিকট থেকে ধান দেওয়ার জন্য আগাম টাকাও নিয়ে থাকেন। এমনকি একজন সরকারি কর্মকর্তা হয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত ধান বিক্রি করা হলে টেন্ডারের মাধ্যমেই হওয়ার কথা।
কিন্তু টেন্ডারের ধারে কাছেও প্রতিষ্ঠানটি নেই। বরং একজন সরকারি কর্মকর্তা নিজের ব্যাংক হিসাবের চেক দিয়ে আগাম সরকারি ধান বিক্রির অভিযোগও রয়েছে।
কক্সবাজারের একজন ব্যবসায়ী উক্ত কর্মকর্তার এরকম একটি চেকের ফটোকপিও প্রদর্শন করেছেন। গত তিন সপ্তাহ আগে এ ঘটনার বিষয়ে এ প্রতিবেদক সুমন চাকমার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি অকপটে স্বীকার করেন, ‘আমি ধান দেওয়ার কথায় বিশ্বাসের জন্য চেকটি ওই ব্যবসায়ীকে দিয়েছিলাম। এখন আমি সেই টাকা ফেরৎ দেব। ’
অভিযোগ ওঠেছে, খামারের প্রায় দেড়-দুই হাজার নারিকেল গাছের বার্ষিক নিলাম যে অংকের টাকায় দেওয়া হয় তার সিকি পরিমাণও সরকারি তহবিলে জমা হয় না। আম-কাঁঠাল গাছের কোনো ফলের টাকাও জমা হয় না সরকারি তহবিলে। একটি বড় পুকুর রয়েছে সেই পুকুরের টাকাও জমা হয় না।
এভাবেই একটি উজ্জীবিত কৃষি বীজ খামার এখন ম্রিয়মান হয়ে গেছে। এমনকি অনেকেই দেউলিয়া হয়ে যাবার উপক্রমের অভিযোগও জানিয়েছেন।
এসব অভিযোগের বিষয় নিয়ে ৩০ নভেম্বর চট্টগ্রামের কৃষি করপোরেশনের যুগ্ম পরিচালক আনন্দ চন্দ্র দাশের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘অনেক আগে থেকেই কক্সবাজারের ঝিলংজা বীজ উৎপাদন খামারের এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযোগ শুনে আসছি। তাঁর বিরুদ্ধে এর আগেও কয়েকবার তদন্ত করা হয়েছে। সব তদন্তও প্রমাণ হয়েছে। একবার তাকে সাময়িক বহিষ্কারও করা হয়। সেই সাথে তাঁকে সতর্কীকরণও করা হয়েছে। দেখা যাক এসব অভিযোগ তদন্ত করে দেখা হবে। ’
কক্সবাজার সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. নোমান হোসেন প্রিন্স সোমবার বলেন, ‘আমি সরেজমিন সরকারি খামারটির মালিকানাধীন ধানি জমি পরিদর্শন করতে গিয়ে জমির টপ সয়েল বিক্রি করে দেওয়ার তথ্য উদঘাটন করেছি। রাতের আঁধারেই এসব জমির টপ সয়েল বিক্রি করে দেওয়া হয়। আমি গিয়ে হাতেনাতে ধরে ফেলি। ’
ইউএনও জানান, এসব বিষযে তিনি সরকারের উচ্চ পর্যায়ে অবহিত করবেন।
পাঠকের মতামত: